সোমবার বিকালে মোবাইল ফোনে শামীমা খানম সাথী জানান, তার বাবার বাড়ি গোপালগঞ্জে। ২০১৫ সালে ঢাকার সাভারে গার্মেন্টসে কাজ করতেন। সেখানে ভালোবেসে বিয়ে করেন বগুড়ার শিবগঞ্জের বুড়িগঞ্জ ইউনিয়নের পঞ্চদাস গ্রামের মৃত দিলবর প্রামাণিকের ছেলে রনি প্রামাণিককে। সাভারের রাজাশন গ্রামে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। বগুড়ার গ্রামে রনিদের কোনো জমিজমা নেই। পরিবারের সদস্যরা খাস জমিতে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে সেখানে অতিকষ্টে বসবাস করেন।
বাড়িতে থাকার ঘর না থাকায় রনি তাকে কোনদিন নিয়ে আসেননি। তার ঘরে ইয়াসিন (৬) ও দেড় বছরের শিশু ইভানের জন্ম হয়। সংসারে অভাব থাকলেও কোনো অশান্তি ছিল না। শিশু ইভান প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে পেটের অসুখে ভুগছিল। স্বামী রনির শরীরও ভাল না থাকায় দুই দিন রিকশা নিয়ে বের হননি। ঘরে তেমন খাবার ছিল না। চাল-ডাল ও ছেলের ওষুধ কেনার জন্য রনি প্রামাণিক ২০ জুলাই সকাল ৯টার দিকে মহাজনের রিকশা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন।
দুপুর ১২টার দিকে প্রতিবেশীদের কাছে জানতে পারেন রনির বুকে গুলি লেগেছে। তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ খবরে সাথীর মাথায় যেন বজ্রপাত ঘটে। তিনি শিশু ইভানকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন রনির নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। তার বুকে ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকার মুদি দোকানি রবিউল ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে স্বজনরা জানান, বেলা ১১টার দিকে রনি যাত্রীর জন্য রিকশা নিয়ে স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের একটি বিক্ষোভ মিছিল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আসে। তখন পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় রনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে যান। সেখানে তার মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ রনির লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।
কিন্তু লাশ বগুড়ার শিবগঞ্জের বাড়িতে আনার মত সমর্থনা ছিলনা। স্থানীদের সহযোগিতায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সাথী ২১ জুলাই রোববার ভোরে সন্তানসহ স্বামীর লাশ নিয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জের বুড়িগঞ্জ ইউনিয়নের পঞ্চদাশ গ্রামে আসেন। বাদ জোহর নামাজে জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।
বগুড়ার শিবগঞ্জের বুড়িগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম চঞ্চল বলেন, তিনি রিকশাচালক রনি প্রামাণিকের মৃত্যুর ব্যাপারে কিছুই জানেন না।
ওই ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য খায়রুন্নেছা বেলি বলেন, রনিদের নিজস্ব কোনো জমিজমা নেই। তাদের পরিবার পঞ্চদাশ গ্রামে খাস জমিতে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করেন। গ্রামবাসীদের সাহায্য সহযোগিতায় তাদের সংসার চলে। খুবই অভাবী পরিবার; তাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
বাবলু সরকার নামে এক প্রতিবেশী বলেন, রনির বাবা দিলবর প্রামাণিক দিনমজুর ছিলেন। চার বছর আগে তিনি মারা যান। এরপর রনির মা শাহানা বেওয়া খাস জমিতে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছেন। রনির মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের এখানে থাকার মতো ঘরও নেই।
রনির মা শাহানা বেগম বলেন, ছেলে রনি প্রতি সপ্তাহে তাকে ৫০০ টাকা পাঠাতেন। এ টাকা ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় তিনি চলতেন। এখন ছেলে আর টাকা পাঠাবে না। কিভাবে তার জীবন চলবে তা নিয়ে তিনি চিন্তিত।
শাহানা বেগম আরও বলেন, বিনা অপরাধে তার বুকের ধন রনিকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ছেলেকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবেন তা নিয়ে বিলাপ করেন। শাহানা বেওয়া তার ছেলের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ও সরকারের কাছে সহযোগিতা দাবি করেন।
সোমবার বিকালে শামীমা খানম সাথী আরও জানান, বাড়িতে খাবার না থাকা ও ছোট ছেলের ওষুধ কেনার জন্যই রনি সেদিন সকালে রিকশা নিয়ে বের হয়েছিল। কিন্তু সে বাজার ও ছেলের ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেনি। হাসপাতালে তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। শ্বশুরবাড়িতে থাকার কোন ব্যবস্থা না থাকায় স্বামীর লাশ দাফনের পর তিনি দুই সন্তানকে বুকে নিয়ে ঢাকার সাভারে রাজাশন গ্রামে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ছোট ছেলে ইভান মায়ের বুকের দুধ পান করায় সাথী এখনই কাজে যেতে পারছেন না। ছেলে একটু বড় হলে আবারো গার্মেন্টসে কাজে যাবেন।
তিনি আরও বলেন, ইভান শুধু আব্বু আব্বু বলে কান্নাকাটি করছে। আদারের আব্বুকে খুঁজে ফিরছে। ঠিকমত দুধ খাচ্ছে না। তার কান্না থামানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সে জানেনা তার আব্বু আর কখনও ফিরবে না। অবুঝ বড় ছেলে ইয়াসিন তাকে বলছে, আম্মু তুমি চিন্তা করিও না। আব্বু শিগগিরই বাড়িতে ফিরে আসবে। তাদের জন্য অনেক খাবার ও খেলনা নিয়ে ফিরবে।
শিশু দুটির কান্না ও আহাজারিতে প্রতিবেশীরা তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। সাথী সন্তানদের সহযোগিতা সমর্থ্যবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন।
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৪, ১০:৩৩ পিএম
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.