২৭ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে পুলিশের ওপর হামলা, স্থাপনা ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা দেওয়াসহ সহিংসতার অভিযোগে সারা দেশে এ পর্যন্ত গত সাত দিনে প্রায় ছয় হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় করা পাঁচ শতাধিক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদের বেশির ভাগ বিএনপি ও জামায়াত–শিবিরের নেতাকর্মী। গ্রেপ্তারকৃতদের বেশির ভাগ ব্যক্তিকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অনেককে রিমান্ডে এনে চলছে জিজ্ঞাসাবাদ। এসব ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে দল দুটির আরো অনেক নেতাকর্মী আছেন। তাঁদেরও গ্রেপ্তারে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। এ পর্যন্ত ঢাকায় ২০৯টি মামলায় দুই হাজার ৩৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৪৮ জনকে।
অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, নাশকতা সৃষ্টিকারীরা থানা, ফাঁড়ি, পুলিশের অফিস, ট্রাফিক বক্স, গাড়ির গ্যারেজসহ ২৩৫টি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করে ভাঙচুর চালিয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের জিপ, পিকআপ, এপিসি, রেকার, ওয়াটার ক্যানন, মোটরসাইকেল, অ্যাম্বুল্যান্সসহ ২৩৩টি যানবাহনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে। সহিংসতা ঠেকাতে গিয়ে এক হাজার ১৩১ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন তিনজন। তাঁরা হলেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া, ট্যুরিস্ট পুলিশের এএসআই মো. মোক্তাদির ও ডিএমপি প্রটেকশন বিভাগের নায়েক মো. গিয়াস উদ্দিন। আহত পুলিশ সদস্যদের বেশির ভাগ রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ছাড়া নাশকতার ঘটনায় আনসারের এক সদস্য নিহত হয়েছেন। এই সংঘর্ষে এ পর্যন্ত পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিজিবির এক হাজার ৩৮১ সদস্য আহত হয়েছেন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় গত ১ জুলাই। এরপর ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি ঘিরে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে সহিংসতা ছড়াতে থাকে। ১৮ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত তিন দিনে সবচেয়ে বেশি হতাহত হন। এর মধ্যে বিজিবির ৫২ জন সদস্য আহত হয়েছেন। র্যাবের শতাধিক সদস্য এবং আনসারের ৯৮ জন সদস্য আহত হয়েছেন।
১৯ জুলাই দিবাগত রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। এর পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক। কোথাও ভাঙচুর কিংবা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। নতুন করে কেউ হতাহত হননি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে কয়েক দিনের নাশকতার ঘটনায় করা মামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় ব্লক রেইড দেওয়া হচ্ছে। ভিডিও ফুটেজের পাশাপাশি স্টিল ছবিসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া ছবি দেখে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করা হচ্ছে।
যেসব স্পটে নাশকতা হয়েছে সেসব স্থানের ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ এখন আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে জানিয়ে তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন ইউনিট এগুলো বিশ্লেষণ করে নাশকতার ঘটনায় হতাহতদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে সারা দেশে চিরুনি অভিযান চলছে।
পুলিশ বলছে, নাশকতার ঘটনায় শুধু পুলিশই নয়, র্যাব, বিজিবি ও আনসারের এ পর্যন্ত ৩১৩টি স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গত ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত এসব নাশকতা চালানো হয়।
এই সংঘর্ষের ঘটনায় চার বাহিনীর প্রায় ৩০০টি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ সময় ভাঙচুর করা হয়েছে তাদের সাঁজোয়া যান, এপিসিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। পাশাপাশি থানায়ও হামলা চালানো হয়।
এর মধ্যে ঢাকায় পুলিশের ৬৯টি পুলিশ বক্সসহ ৮০টি স্থাপনা ও কার্যালয় ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়েছে। এতে ডিএমপির ৬১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।র্যাবের ১৩টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৭৮টি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
যা বলেছেন ডিবিপ্রধান
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল বলেন, ‘সংঘর্ষের সময় কারা হামলা চালিয়েছে, তা আমরা জানি। সে অনুযায়ী আমরা নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনছি।’
বিএনপি–জামায়াত দেশকে অকার্যকর করার চেষ্টা করেছে এবং তারা পুলিশের কারণে বারবার ব্যর্থ হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।’
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার জানিয়েছেন, এই নাশকতা, হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞে জড়িত জামায়াত ও বিএনপি চক্র। তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, ডিএমপি তাই করবে। সহিংসতা সৃষ্টিকারীরা যেন ঢাকা শহর না ছাড়তে পারে, সেই লক্ষ্যে ডিএমপি পরিকল্পনা করছে। সন্ত্রাসীরা যেখানেই থাকুক, তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হবে। যারা বিটিভি ভবনে হামলায় জড়িত ছিল, যারা সেতু ভবনে হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রো রেল ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত ছিল, তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনা হবে।
রায়েরবাগে দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যার ঘটনায় ছাত্রদল নেতাসহ ৬ জন গ্রেপ্তার
কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে সহিংসতা ছড়িয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ ও শনির আখড়া এলাকায় দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রদল নেতাসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি–সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। তাঁরা হলেন ডেমরা থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুদ রানা, ইরফান, আবু বক্কর, রবিউল ইসলাম, সৌরভ মিয়া ও তারেক।
ডিবি বলছে, ডেমরা থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুদ রানার নেতৃত্বে পুলিশ হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। একেকজনের ছিল একেক দায়িত্ব। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গতকাল মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকৃত ডেমরা থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মাসুদ রানার নেতৃত্বে ইরফান, আবু বক্কর, রবিউল ইসলাম, সৌরভ মিয়া, তারেকসহ ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি দল গত ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে যাত্রাবাড়ী থানাধীন রায়েরবাগে অবস্থান করে। এ ছাড়া মাসুদ রানার উপস্থিতি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় ইরফান ও আবু বক্কর আরো কয়েকটি দল নিয়ে এসে মাসুদ রানার সঙ্গে যোগ দেন। মাসুদ রানার নেতৃত্বে তাঁরা রায়েরবাগ–শনির আখড়া এলাকায় অগ্নিসংযোগ এবং মসজিদের মাইকে গুজব ছড়িয়ে থানা আক্রমণ ও পুলিশ হত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
ডিবিপ্রধান বলেন, মাসুদ রানা যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ ও শনির আখড়া এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করেন। ইরফান ও মাসুদের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যদের হত্যা ও মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। আবু বক্কর পুলিশ সদস্যকে মারধর এবং মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করেন। এ ছাড়া গ্রেপ্তার রবিউল ইসলাম হকিস্টিক দিয়ে পুলিশ সদস্যদের মারধর এবং মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগে সহায়তা করেন। সৌরভ মিয়া বাঁশের লাঠি দিয়ে পুলিশ সদস্যদের মারধর করেন। তারেক লাঠি দিয়ে পুলিশ সদস্যদের মারধর এবং মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগে সহায়তা করেন
আরেকজন গ্রেপ্তার
নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সোনালী আক্তার নামের এক সাংবাদিক হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহিদুল ইসলাম টিটুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নুরুল হক নুর কারাগারে
রাজধানীর বনানীর সেতু ভবনে হামলার ঘটনায় করা মামলায় গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাকিল আহম্মদের আদালত নুরের জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এদিন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের পরিদর্শক আবু সাইদ মিয়া পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে নুরকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। নুরের পক্ষে খাদেমুল ইসলাম জামিন চেয়ে শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করে। শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর আগে গত ২১ জুলাই নুরের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
আমীর খসরুসহ বিএনপি–জামায়াতের ৪০৫ জন কারাগারে, রিমান্ডে ৪১
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নাশকতার ঘটনায় হওয়া মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বিএনপি–জামায়াতের ৪০৫ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।
সাংবাদিক সাঈদসহ ৫ দিনের রিমান্ডে ৬ জন
রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া মেট্রো রেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় করা মামলায় সাংবাদিক হাফিজ আল আসাদ ওরফে সাঈদ খানসহ ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
রিমান্ডে নেওয়া অন্য আসামিরা হলেন সানাউল হক নিরু, আলমগীর, মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া ওরফে নাইম, আব্দুল আজিজ সুলতান ও মাইন।
গতকাল তাঁদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের পল্লবী জোনাল টিমের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান মুন্সী তাঁদের ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানান।
অন্যদিকে সাঈদ খানের পক্ষে তাঁর আইনজীবী দেলোয়ার জাহান রুমী রিমান্ড বাতিল করে জামিনের জন্য আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরোবিয়া খানম তাঁদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.