গত এক মাসের বেশি সময় ধরে নির্বাক মো. নুরুল ইসলাম (৬১)। কোমরের ব্যথা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ থাকলেও ক্ষুধার যন্ত্রণায় রিক্সা নিয়ে রাস্তায় বের হতে হয়েছেতাকে। ঢাকার লালবাগ এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গুলিতে মারা যাওয়া গার্মেন্ট শ্রমিক নয়নের (৩৫) পিতা তিনি।তিন ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধূ, ছোট্ট নাতনিসহ নুরুল ইসলামের আটজনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল নয়ন।
জোয়ান বয়সে নুরুল ইসলাম একজন মাটিকাটা শ্রমিক ছিলেন পরবর্তী ইট ভাঙাগাসহ ভারি পণ্য বহণের কাজ করতেন। এসব কষ্টের কাজ করেই ছেলে সংসার চালাতেন। গত তিন বছর যাবত বয়সের ভারে তিনি বিছানায় পড়ে যান এবং বড় ছেলে নয়ন সংসারের হাল ধরেন। ছেলে বিয়ে করে এবং তার একটা কন্যা সন্তান হয়।
কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহত হয় নয়ন, যে ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই শোকে পাথর যুবতী স্ত্রী। মুখে কোনো খাবার নিচ্ছেন না ঠিকমতো। মায়ের মতোই শোকে মুষড়ে গেছে ২ বছরের মেয়ে ছোট্র মেয়েটি। সে বুঝতেই পারছে না তার বাবা চলে গেছে অজানা এক দেশে, যেখান থেকে সে আর কখনো ফিরবে না। কিন্তু নিয়ম করে সন্ধ্যার দিকে কেউ আর চকলেট/চিপস নিয়ে বাসায় আসে না তার জন্য এটা অনুভব করেই প্রতিদিন কান্না করে। চিরচেনা কোনো এক মুখ তাকে আর কোলে নিয়ে আদর করে না, সেই স্নেহ ভালবাসার ঘাটতিও অনুভব করতে পারে। তার ছোট্ট দুটি চোখ খুঁজে ফিরছে বাবাকে। বুড়িগঙ্গার পাড়ে লালবাগ এলাকায় বসবাস করতেন নয়ন। গত ৫ আগস্ট সকাল ৮টায় অসুস্থ বাবাকে আশ্বস্থ করে বাসা থেকে বের হয়। কথা ছিল খুব শিগগিরই বাবাকে ভালো ডাক্তার দেখাবে, আগামী বছরই মেয়েকে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করবে। মেয়ের ঠাণ্ডা লেগেছিল। সকালে নাস্তা খেয়ে, মেয়ের জন্য ঔষধ নিয়ে আসবে বলে বউয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু কে জানত, এ বিদায়ই হবে চির বিদায়। বিকালে একবার বাসায় এসেছিল,কিন্তু বেশিক্ষণ বাসায় অবস্থান করেননি। খুব উচ্ছাস আর আনন্দ নিয়ে বলছিল এবার ছোট ভাইয়ের চাকরি হবে, ঘুছে যাবে তাদের অভাব।
সফল গণঅভুত্থ্যানের পর ছাত্র-জনতা রাত আনুমানিক ৯ট থেকে সাড়ে ৯টার দিকে বেরিবাঁধ সংলগ্ন পানিন গার্মেন্টসের সামনে পাকা রাস্তার ওপর একটি আনন্দ মিছিল বের করে। উক্ত মিছিলে নয়নও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মিছিলটি লালবাগ থানার কাছাকাছি আসলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিকলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মিছিলে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে এবং নয়নের বুকের বাম পাজরে চারটি গুলি বিদ্ধ হলে নয়ন রাস্তার লুটিয়ে পড়েন। নয়নসহ গুলিবিদ্ধ আরও অনেকে রাস্তায় পড়ে থাকে। নয়নের মোবাইল থেকে পথচারী তার বাবার মোবাইল এ কল দিয়ে জানালেন, মুমূর্ষ অবস্থায় নয়নকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সারা বাংলাদেশে তখন এক ভীবিষিকাময় অবস্থা বিরাজ করছিল বিধায় ঢাকা মেডিকেলে তখন তাকে ভর্তি নেয়নি। সারা রাত বিনা চিকিৎসায় পড়ে ছিল। পরদিন সকালে ৬ আগস্ট তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করানো হয় এবং কর্তব্যরত ডাক্তার নয়নের বুকে অস্ত্রাপাচার করে চারটি গুলি বের করেন। নয়নের শারিরীক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হলে ৯ আগস্ট সকাল ৮টা ১০ মিনিটে ধানমন্ডির ২৭ এ সুপারম্যাক্স হসপিটালে স্থানান্তর করা হয়। ঐদিন সকাল ১০টায় অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। আইসিইউতে আনুমানিক বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে কর্তব্যরত ডাক্তার নয়নের মৃত্যু ঘোষণা করেন। প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে নয়নকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করানো হয়।
মৃত্যুর দুই মাস পার হলেও, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের খোঁজখবর নেওয়া হয়নি, পাইনি কোনো অনুদানও। অভাবের কারণে অসুস্থ শরীর নিয়েই রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন নুরুল ইসলাম। নয়নের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে কাতর পুরো পরিবার।
উল্লেখ্য, গত ১০ অক্টোবর এলাকাবাসীর সহায়তায় লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। লালবাগ থানার ওসি (তদন্ত) আহসান উল্লাহ মামলার বিষয় নিশ্চিত করে বলেন, আমরা আসামিদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি এবং গ্রেফতারের অভিযান চালাচ্ছি। শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.