কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে দুর্বৃত্তরা বৃহস্পতিবার থেকে টানা ৩ দিন রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছে শিল্প ও বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে। দুর্বৃত্তদের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পায়নি সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। তাণ্ডবের রোষানলে লাঞ্ছিত ও বর্বরোচিত আচরণের শিকার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরাও। মঙ্গলবার থেকে পুরো জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে চললেও সেই বিভীষিকাময় তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। আর এখনো আতঙ্কে আছেন সাধারণ মানুষ। নাশকতা এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে অনেকেই তাণ্ডবকারীদের নাম মুখে নিতেও ভয় পাচ্ছেন। তবে গত দুদিনে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র্যাবের তৎপরতায় ধীরে ধীরে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে চিরচেনা নারায়ণগঞ্জ। আর নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে বিশেষ অভিযানে নেমেছে জেলা পুলিশ।
সরেজমিন দেখা গেছে, এ যেন কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দৃশ্য। চারদিকে আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া ধ্বংসলীলা দেখলে বোঝার উপায় নেই এটাই সেই কর্মচঞ্চল শিল্প ও বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ডাকা শাটডাউন কর্মসূচির দিনই মাঠে নামে ইসলামী ছাত্র শিবিরের শত শত পুরুষ ও নারীকর্মী। ওই দিন তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ইসলামী আন্দোলনের ছাত্র সংগঠনসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। নগরীর প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়ার পরই পুলিশের সঙ্গে ঘটে ত্রিমুখী সংঘর্ষ। সন্ধ্যা থেকে রাতভর চলে তাণ্ডব। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় শহরের নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, পিবিআই কার্যালয়, যুব উন্নয়ন কার্যালয়সহ প্রায় অর্ধশত যানবাহন। তছনছ করে দেওয়া হয় এসব সরকারি অফিসের বিভিন্ন কক্ষ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় প্রায় অর্ধশত মোটরসাইকেল।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিএনপি ও শিবিরের একটি যৌথ মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে নগরীর প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু রোড অবরোধের চেষ্টাসহ বিভিন্ন মার্কেটে লুটপাটের চেষ্টা চলে। শহরে নাশকতা ঠেকাতে নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে নামেন আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য শামীম ওসমান। এ সময় তাকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা ককটেল ও গুলি ছুড়লে শুরু হয় সংঘর্ষ। শামীম ওসমান নগরীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নেতাকর্মীদের নিয়ে টহল শুরু করলে নাশকতাকারীরা পিছু হটে। এরপর শামীম ওসমানের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় পৌঁছালে সেখানেও শত শত নাশকতাকারী পিছু হটে। কিন্তু সন্ধ্যার পরই শুরু হয় চোরাগোপ্তা হামলা। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় পুরো শহরের ইন্টারনেট কেবলে। লিংক রোড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তাণ্ডবকারীদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় লিংক রোডের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক, শীতল ট্রান্সপোর্টের ২৬টি এসি বাস, একটি বহুতল রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট ভবনসহ আরও ২০টি যানবাহন। ওই রাতেই আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় নগর ভবনের নিচ তলায়। কারফিউ ঘোষণার পরও থামেনি তাণ্ডব। চোরাগোপ্তা হামলা করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় যানবাহন, সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক মোড়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ভবনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই ভবনে আটকে পড়া হাইওয়ে পুলিশের সদস্যদের পরে র্যাবের হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করা হয়।
এদিকে তাণ্ডবের এই ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক এখনও কাটেনি। নাশকতাকারীদের চিনলেও তাদের নাম মুখে আনতে ভয় পাচ্ছেন তারা। তবে প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়রা ও মাঠে থাকা গণমাধ্যম কর্মীরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার শাটডাউন কর্মসূচিতে লিংক রোড ও চাষাঢ়ায় হাজী মিছির আলী কলেজ, আদর্শ স্কুল, ডক্টর মাহাবুবুর রহমান কলেজ ও জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াস উদ্দিনের মালিকানাধীন গিয়াস উদ্দিন মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাই ছিল বেশি। তবে শুক্রবার থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেখা না মিললেও অংশ নেওয়া অধিকাংশই ছিল ছাত্রদল ও শিবিরের সক্রিয় কর্মী।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.